মনির আহমদ, পিবিএ, সিঙ্গাপুর: দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মিশ্র ভাষা ও সংস্কৃতির দেশ সিঙ্গাপুর। সাগরের বুকে হিরাকৃতির পাথর ও পাহাড়ের একটি ছোট দ্বীপরাষ্ট্র, আয়তনে বাংলাদেশের একটি জেলার সমান। দ্বীপরাষ্ট্রটি ছোট-বড় ৬৩টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত, সবচেয়ে চাকচিক্যময়, উন্নত ও জনপ্রিয় দ্বীপটি হচ্ছে সেন্তোসা, যেখানে রয়েছে উড়ন্ত ট্রেনে ও গাড়িতে যাতায়াতের সুবিধা, সেন্তোসায় রয়েছে আধুনিকতার সর্বোচ্চ ব্যবহার। কল্পনার সব রঙ নিয়ে দ্বীপটিকে সাজানো হয়েছে একটি উন্নত শহরের মতো করে। সম্প্রতি গিয়েছিলাম আমার পছন্দের একটি দ্বীপে যেখানে রয়েছে সিঙ্গাপুরের প্রাচীনতা, ঐতিহ্যের ছোঁয়া ও মানুষের মাঝে সিঙ্গাপুরের শিকড়ের দাগ। এই দ্বীপের নাম পোলাও উবিন, দ্বীপটি সিঙ্গাপুরের মূল ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত, চাঙ্গি ভিলেজ নামক স্থান থেকে স্পীডবোটে যাতায়াত করতে হয়। দ্বীপটির দৈর্ঘ প্রায় ১০বর্গ কিলোমিটার, চাঙ্গী ভিলেজ থেকে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের নৌকাভ্রমণে পৌঁছানো যায় এই দ্বীপে। দ্বীপটিতে যাওয়ার আগে দ্বীপের ইতিহাসে জেনে নেই। পোলাও উবিন একটি মালয় ভাষা, পোলাও অর্থ দ্বীপ আর উবিন অর্থ হচ্ছে গ্রানাইট পাথর অর্থাৎ গ্রানাইট পাথরের দ্বীপ। ধারণা করা হয় এই দ্বীপের দৃশ্যমান লালচে রঙের গ্রানাইট পাথরগুলো প্রায় ৫০০০ হাজার বছরেরও অধিক পুরনো। সিঙ্গাপুর স্বাধীনতার আগে ও পরে এখানের মূল্যবান অনেক গ্রানাইট পাথর সরিয়ে নিয়ে বিভিন্ন স্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
রূপকথা আছে বহু বছর আগে সিঙ্গাপুরের মূল ভূখণ্ড থেকে একটা ব্যাঙ, একটি শুকর ও একটি হাতি জোহর বাহরু যাওয়ার জন্য সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল। প্রতিযোগিতায় যে হেরে যাবে সে পাথরের রূপ নেবে শেষপর্যন্ত শুকর ও হাতি দুজনে পাথুরে হয়ে যায় এই দ্বীপে এসে আর ব্যাঙ চলে যায় পোলাও সেকুদু(Pulau sekudu) দ্বীপে যার অন্যনাম ব্যাঙ দ্বীপ (Frog Island) ।
পোলাও উবিনের সাম্প্রতিক ইতিহাস হচ্ছে এখানে একসময় প্রায় দুই হাজারের অধিক পরিবার বসবাস করতো ১৯৫০ দশকের পরে এখানের মানুষের শিক্ষা বিস্তারে দুইটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ছাত্রছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৪০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে সিঙ্গাপুর সরকার ১৯৮০এর দশকে স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয় এবং ২০০৫ সালে ঘোষণা দেন দ্বীপ থেকে যারা স্থায়ীভাবে চলে আসবে তাদের সরকারি বাসা দেয়া হবে। বর্তমানে এই দ্বীপে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন ৩৮টি পরিবার।
সিঙ্গাপুরের উল্লেখযোগ্য অঞ্চল ক্যামপং বাহরু, বিশান, সেরাঙ্গুন, ট্যাম্পিনেস, লেভেন্ডার, কালাং, গ্যালাং, টানামেরা, কাকিবুকিত হয়ে ২, ২৯, ৫৯, ১০৯ নাম্বার বাসগুলো নিয়মিত চাঙ্গী ভিজেল এসে তাদের গন্তব্য শেষ করে। দিনব্যাপী ভ্রমণের জন্য সকাল সকাল এখানে এসে হাজির হতে হবে। বাস থেকে নেমেই খেয়ে নিতে পারেন সকালের খাবার কিংবা ক্যান্টিনের বারান্দায় বসে চা, কফি পান করতে করতে সকালটাকেও উপভোগ করতে পারেন প্রাণখুলে। নামে চাঙ্গী ভিলেজ হলেও জায়গাটা মোটেও গ্রাম নয় তবে এখানের প্রকৃতি, পথ ও স্থাপনায় কিছুটা বিচিত্রিতা রয়েছে। পোলাও উবিন তুলনামূলক অনেক বড় দ্বীপ একদিনের সফরে ভ্রমণ করা প্রায় অসম্ভব তাই পছন্দসই গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে প্রাধান্য দিয়ে অনেকেই ভ্রমণের গতিপথ ঠিক করে নেন। নৌকায় চড়ার আগে সাথে নিয়ে নেন প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন পানীয়, দুপুরের খাবার, ছাতা কিংবা রেইনকোর্ট। পোলাও উবিনে আমার দ্বিতীয় ভ্রমণটি ছিল বৃষ্টিমুখর, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ছিল সারাদিন তাই সাথে নিয়েছিলাম ছাতা ও রেইনকোর্ট।
তৃতীয় ভ্রমণটি হলো ৫ই জুন ২০১৯ইং পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন। সকালে ঈদের নামাজ শেষে কাকিবুকিত থেকে ৫৯ নাম্বার বাস ধরে সোজা চলে এলাম চাঙ্গী ভিলেজ। সবার আগে চলে আসায় বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা, পাশাপাশি চললো পোলাও উবিন সম্পর্কে জানা অজানা তথ্য সংগ্রহের কাজ। চাঙ্গী খেয়াঘাটের কাছ দিয়েই একটি খাল চলে গেছে শহরের দিকে, দূরে শহরের উঁচউঁচু বিল্ডিং দেখে মনে হয় তৃষ্ণার্ত শহর যেন এই জলের অপেক্ষায় বসে আছে। খেয়াঘাটের সামনেই পায়ে হাঁটার সরু একটি সেতু নান্দনিকতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওপারে গেলেই সাগর, এই জায়গাটিও সময় কাটানোর জন্য চমৎকার, এঁকেবেঁকে বিভিন্নদিকে চলে গেছে পায়ের পথ। কেউ কেউ সখে ও সুখে সাইকেলে প্যাডেল চাপছে তবে সূর্যডোবা মূহুর্তে জায়গাটি খোশগল্পের জন্য চমৎকার হবে বুঝাই যায়।
বন্ধুরা এসে পৌঁছলো সকাল ১১টা ৩০এর দিকে। এরপরে শুরু হলো খেয়াঘাটে টিকিটের জন্য অপেক্ষা, আমরা জানিয়ে দিলাম আমরা ৯জন আছি, ঘাট কতৃপক্ষ সেই অনুযায়ী আমাদের সিরিয়াল দিলো, মূলত একটি স্পীডবোটে ১২জন করে নেয়া হয় সে অনুযায়ী আমাদের সাথে বাড়তি ৩জন যুক্ত করে স্পীডবোট ছাড়লো। জাকির, মোহর, বেলাল, সুমন ভাই ও আমিসহ ৪জন বিদেশি বন্ধু ছিল আমাদের ভ্রমণে। যাওয়ার জন্য ৩সিঙ্গাপুর ডলার ভাড়া জনপ্রতি পরিশোধ করতে হলো। সাঁতার না জানা লোকদের জন্য ভ্রমণটি ঝুঁকিপূর্ণ না হলেও অনেকটা ভীতিকর হতে পারে, কারণ স্পীডবোট তুলনামূলক খুব ছোট ও হালকা এবং চলার পথে প্রচুর ঢেউয়ের সৃষ্টি করে যার ফলে পার্শ্ববর্তী স্পীডবোটের ঢেউয়ে দারুণ দুলিয়ে ওঠে। সাঁতারের অভিজ্ঞতা থাকায় এই দোল আমাদের সকল বন্ধুদের মাঝেই অন্যরকম উন্মাদনার সৃষ্টি করলো। স্পীডবোটের যান্ত্রিক শব্দ, সিঙ্গাপুর সাগরকে দুভাগ করে ছুটে চলা, পাশাপাশি বিভিন্ন পাখির ওড়াওড়ি এক অপরুপ চিত্রকল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়।
১৫ মিনিট পরেই পোলাও উবিন পৌঁছলাম পোলাও উবিন জেটি খেয়াঘাটে। জেটি অর্থ হাটবাজার, পোলাও উবিনের হাট যেন বাংলাদেশের অজপাড়া গ্রামের নদী কেন্দ্রীক হাটবাজারের সাথে একাকার হয়ে গেছে। এখানে রয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্য ধারণ করে বেঁচে থাকা সব আয়োজন। খাবারের হোটেল, মুদি দোকান, ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, চায়ের দোকান, পাশেই রয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি, ছোটখাটো একটি চাইনিজ মন্দিরও দাঁড়িয়ে আছে এখানে। বলা যায় এখানে বসবাস করা ৩৮টি পরিবারের প্রধান কেন্দ্র এই জেটি। মূলত এখানের বেশিরভাগ ব্যবসা, ও নৌকার মাঝি এই ৩৮ পরিবারের লোকদেরই পেশার অন্তর্ভুক্ত। আমরা পোলাও উবিন পৌঁছতেই চাইনিজদের একটি ধর্মীয় বহর মন্দির থেকে বেড়িয়ে খেয়াঘাটের দিকে বাদ্য বাজাতে বাজাতে ছুটে গেলো।
দ্বীপজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্নরকম ফল তারা সংগ্রহ করে এখানে বিক্রি করেন, উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সিঙ্গাপুরের জাতীয় ফল ডোরিয়ান। ওয়েলকাম টু পোলাও উবিন লেখা গেটটি অতিক্রম করলেই হাতের বাম পাশে চোখে পড়লো পোস্ট বক্স মূলত এখান থেকে চাইলে চিঠি প্রেরণ করা যাবে যেকোন দেশে, সম্মুখে রয়েছে পোলাও উবিনের সম্পূর্ণ মানচিত্র, কোথায় গেলে কী কী পাওয়া যাবে সব এখান থেকে নিশ্চিত হয়ে সবাই ভ্রমণ যাত্রা শুরু করে, আমরাও তাই করলাম।
মানচিত্রের পেছনে রয়েছে ফ্রেশ হওয়ার ব্যবস্থা, সাথেই রয়েছে রেস্ট রুম যেখানে অত্যাধুকিকভাবে সাজানো আছে পাখি পরিচিতি। এখানে উল্লখযোগ্য পাখি মাছরাঙা ও বুলবুলের পাশাপাশি অন্যান্য পাখির ভিডিওচিত্র ও সুর শোনা যায়, সাথে দেখে নিলাম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও। বাম পাশেই রয়েছে বিভিন্ন দোকান প্রথমে মালয় ক্যাফের পরেই চোখে পড়লো ট্যাক্সি স্ট্যান্ড এখানের ট্যাক্সিগুলো পোলাও উবিনের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত করে, কাঠের খামে উপরে টিনের একচালা নিচে মাটি ও পাথরের উপরে দুইটা বেঞ্চ নিয়েই মূলত ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের অফিস। অফিস ঘরের সামনে রংতুলিতে আঁকাবাঁকা করে লেখা আছে Taxi Service সুতরাং কারও ভুল করার সুযোগ নেই। পাশেই রয়েছে সাইকেল ভাড়া দেয়ার দোকান দিনব্যাপী চুক্তিতে নিয়ে নিতে পারেন এরপরে ছোটতে পারেন যেদিকে চোখ যায়। অনেকেই এখানে সাইকেল চালাতে এসে থাকেন কেউ কেউ নিজস্ব সাইকেলও নিয়ে আসেন এজন্য সাইকেল প্রতি অতিরিক্ত ২সিং ডলার পে করতে হয়।
২০১৬ সালের ২৪ শে এপ্রিল আমার প্রথম সফরে চেক জাওয়া পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলাম ওখানে যেতে প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ পায়ে হাঁটতে হয়। তৃতীয় ভ্রমণটি হলো ট্যাক্সিতে আমরা ৯জন মিনিবাসে চেপে বসলাম ১২সিটের মিনিবাস হওয়ায় আমাদের ১২ সিটের ভাড়া আসাযাওয়া ৪সিং ডলার করে ৪৮ডলার পরিশোধ করতে হলো। আমরা ছোটলাম চেক জাওয়ার উদ্দেশ্যে। ৮ফিট সরু পিচঢালা পথ ধরে যেতে যেতে মনে হলো কোন অজপাড়া গ্রাম পার হয়ে যাচ্ছি যাচ্ছি প্রিয় কোন মানুষের কাছে, চোখে পড়লো স্থানীয়দের বাড়ি, বাড়িগুলোর উপরে টিন, কাঠ, টিন ও প্লাস্টিকের বেড়া যেন সংস্কার হয়নি কয়েক যুগ ধরে। এক বাড়িওয়ালাতো সাজিয়েছেন চমৎকার কফি হাউস সেখানে পাওয়া যায় কোমল পানীয়, বিভিন্ন ড্রিংকস, বিভিন্ন ফল এবং চা কফি, রাস্তার পাশের জায়গাটায় এলোমেলোভাবে রয়েছে অসংখ্য চেয়ার ও টেবিল, চাইলে ঘন্টাখানেক আড্ডা দিলেও অসুবিধে নেই।
রাস্তার দুইধারের বনাঞ্চলের ফাঁকেফাঁকে দেখতে পেলাম নাড়িকেল, ছোট ছোট ডোরিয়ান নাম জানা অসংখ্য ফল মাটিতে বিছিয়ে আছে, দুই একটা রামবোটানের গাছও লক্ষ্য করা যায়, এখনো তা পরিপক্ক হয়নি হয়তো কিছুদিন পরেই খাওয়ার উপযুক্ত হবে। কিছুদূর যেতেই সুন্দর ও মসৃণ পিচঢালা পথ হারিয়ে গেলো, উস্কোখুস্কো পথ উঁচু থেকে নিচুতে ঢলে পড়ছে আবার উঁচুতে উঠে যাচ্ছে। গ্রামীণ জীবনের ব্যতিক্রম হিসেবে এখানে দেখা গেলো কিছুক্ষণ পরপরে বিশ্রামাগার, বিভিন্নরকমের বৃক্ষ ও তার বর্ণনা সম্বলিত ফলক।
চেক যাওয়া পৌঁছে বাকি ভ্রমণ অবশ্য পায়েই হেঁটেই করতে হয় সাইকেল ট্যাক্সি সব এখানে থামে। এখানে দেখা মিললো বানর শুকর, বনমোরগ ও নেড়িকুকুর। কুকুর, শুকর কাছে আসলেও এরা ক্ষতিকর নয় তবে বানর দেখলাম খুব কাছাকাছি ঘুরাঘুরি করছে সুযোগ পেলেই এর ওর হাতের ব্যাগ টেনে নিতে চাইছে।
জেনে নিলাম, সিঙ্গাপুরের সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় জানা গেছে এই দ্বীপে প্রায় ১০২টি প্রজাতির বসবাস রয়েছে যা আগের গবেষণায় ছিল ৪০টি।
চেক যাওয়া (Chek Jawa wetlands) হচ্ছে এক ব্যক্তির নাম, যার নামানুসারে বহুবছর আগে এই স্থানকে চেক যাওয়া বলা হয় বলে শুনেছি এখানে রয়েছে তার চমৎকার ইটের নির্মিত অট্টালিকা যা তিনি প্রত্নতাত্ত্বিকের হাতে তুলে দিয়ে সিঙ্গাপুরের মূল ভূখণ্ডে চলে গেছেন এখন এই বাড়িটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
অট্টালিকার পেছনেই সমুদ্র, যেখানে নির্মিত হয়েছে চমৎকার হাঁটার সেতু, সেতু হেঁটে গেলাম শেষপ্রান্তে, মনে হলো সমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি, চারদিক থেকে এলোমেলো বাতাস আমাকে দুলিয়ে যাচ্ছে।
চেক জাওয়ার মূল পয়েন্ট থেকে ১৮০ মিটার দূরত্বেই রয়েছে বোর্ডওয়াক হেঁটে যেতেই চোখে পড়লো বেশকিছু মুসলিমের কবর, এর পাশেই বিশালাকৃতির গ্রানাইট যেন বসে আছে আমার অপেক্ষায় যুগ হতে যুগ ধরে। মেটে রঙের এই পাথর আমাকে প্রাচীন কোন সভ্যতার কথাই মনে করিয়ে দিলো।
কিছুদূর যেতেই মনে হলো এই পথ আর যায়নি কোথাও, পাহাড়ের উপর দিয়ে চাষের জমির আইলের মতো সুক্ষ্ম একটি পথ আমাকেও অন্য বন্ধুদের মতো ভাবিয়ে তোললো। যেহেতু দিকনির্দেশনা করা এই পথেই বোর্ড ওয়াক ওয়ে সুতরাং আমরা হাঁটলাম পথ ধরেই।
বোর্ড ওয়াকের কাছে এসে দেখলাম এটি মূলত ভূমি পেরিয়ে পাথরের পাহাড়ের পাশ দিয়ে সমুদ্রের বুক হয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা সেতু। আমার কাছে পোলাও উবিনের সবচেয়ে দর্শনীয় জায়গা মনে হয়েছে এটি। হেঁটে যেতে যেতে মনে হলো সাগরের ওপারে সিঙ্গাপুরের Tekong দ্বীপের উঁচু পাহাড় আমায় ডাকছে, অবশ্য পোলাও উবিন দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গটি মূল ভূখণ্ড থেকে ৭৫ মিটার উঁচুতে যা মোটেও কম নয় তবে সেখানে ওঠার মতো ব্যবস্থা এখনো হয়নি।
যাইহোক বোর্ড ওয়াক হয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম এবং শুনলাম বিশালাকৃতির লাল পাথরের বুকে ঢেউ কিভাবে আছড়ে পড়ছে আবার চুপচাপ নেমে যাচ্ছে। আর একটু হেঁটেই অবাক হলাম এখানের ম্যানগ্রোভ ও গোলপাতার গাছগুলো যেন ঘোরের ভেতর দিয়ে সুন্দরবনে নিয়ে যাচ্ছে। বোর্ড ওয়াক কখন যে স্যাঁতসেঁতে মাটি স্পর্শ করে কাঠের পুলে রূপ নিয়ে বন বাদার হয়ে ছুটে যাচ্ছে, এই ঘোর থেকে বেড়িয়ে তা বুঝতে কিছুটা সময় লেগে গেলো।
আনারস ভেবে কাঠের পুল থেকে নেমে হঠাৎ বনে প্রবেশ করলাম কিন্তু অবাক এ যে আনারস নয় অন্য জাতের ফল যা সম্পর্কে জানিও না আর নিয়ে আসাও অসম্ভব। ততক্ষণে সাথের বন্ধুরা চলে গেছে অনেক পথ, চারদিকে একদম নির্জন ও নিস্তব্ধ পড়ন্ত বিকেল তখন বৃক্ষেরা আলো বন্দী করে অনেকটা আঁধার করে ফেলেছে, কিছুটা ভয়ের উদগ্রীব হলোও বটে। কাঠের পুলে উঠেই এক বন্ধুকে পেয়ে গেলাম যেতেযেতে চোখে পড়লো নানা প্রজাতির কাঁকড়াদের আবাসভূমি অনেকটা স্বচ্ছল পরিবারের মতো সবার আলাদা আলাদা বাসা, গুইসাপ, কাঠবিড়ালির দেখাও পেলাম পথে পথে।
পথটি আবার ঘুরেফিরে চেক জাওয়ায় গিয়ে ওঠেছে, পথিমধ্যে পেয়ে গেলাম ভিউ টাওয়ার লোকজন এই টাওয়ারকে জিজাই টাওয়ার বলে থাকেন। এটি ২০মিটার উঁচু, এখানে উঠে উপভোগ করলাম পাখিদের জীববৈচিত্র্য, গোলপাতা, ম্যানগ্রোভ, জানা অজানা অসংখ্য বৃক্ষেরা কীভাবে হা হয়ে আছে আকাশের দিকে। মাছারাঙা, বুলবুল, বাজপাখি সাতে বেশকিছু পরবাসীপাখীও এখানে এসে শীতের মৌসুমে আশ্রয় নেয়।
এখানে দাঁড়িয়ে মনে হলো পাশের দ্বীপগুলোর পাহাড়ে উড়ে যাই পাখি হয়ে, সাগরের বুকে ছোট ছোট নৌকা দেখে মনে হলো হাঁস হয়ে ভেসে থাকি। আমার বন্ধুরা ইতিমধ্যে মনোমুগ্ধকর এই সময়কে উপভোগ্য করতে কবিতা পাঠের আয়োজন করেছেন। আমি পড়লাম জীবনানন্দের কবিতা
আমি যদি হতাম বনহংস
বনহংসী হতে যদি তুমি
কোন এক দিগন্তের জলসীঁড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে।
ছিপছিপে সরের ভেতর এক নিরালা নীড়ে…
দেখতে দেখতে বিকেল প্রায় ৫টা ৩০ বেজে গেছে, মূলত ৫টা থেকেই দ্বীপটি সবাই ছেড়ে যেতে শুরু করে। চেক জাওয়ায় অট্টালিকার পাশের ফ্রেশরুম থেকে মোটামুটি সবাই নিজেকে পরিপাটি করে নিলাম এবার ফেরার পালা আমরা তৃতীয় সফরটি মিনিবাসে করে এসেছিলাম, ড্রাইভার আংকেল আমাদেরকে তার মোবাইল নাম্বার দিয়ে গেছেন ফোন দিতেই কিছুক্ষণ পরে তিনি চলে এলেন।
আমার দ্বিতীয় সফরটি ছিল ২০১৮ সালে, বৃষ্টি মুখর সেই সফরটি ছিল সম্পূর্ণ রেইনকোর্ট পরে যা সম্পর্কে এখন খুব কিছু মনে নেই। যাইহোক শেষ সফরটি পোলাও উবিন খেয়াঘাট হয়ে আগের মতোই আমরা ৯জন চলে এলাম চাঙ্গী ভিলেজে, এখানে কিছুক্ষণ চা খেতে খেতে বিশ্রাম নিলাম এরপরে সবাইকে বিদায় দিয়ে বাসে ওঠলাম, ছোটলাম আমার গন্তব্যের ঠিকানায়।
সিঙ্গাপুরের বেশকিছু দ্বীপে ভ্রমণ করলেও এই দ্বীপটিতে যতবার ভ্রমণ করি যেন ততোবারই নতুন কিছু খুঁজে পাই, আরও বহুবার ভ্রমণের ইচ্ছে আছে এই দ্বীপে। কী যেন এক ঘোর লেগে থাকে এই দ্বীপে, যেন খুঁজে পাই এখানে আমার শৈশবের লঞ্চঘাট, বাসস্ট্যান্ড, বাজার। যেন প্রিয়চেনা কতকিছু পদ্মানদীতে ডুব দিয়ে এখানে ঠাই নিয়েছে। আরও মনে হয় কোন চরাঞ্চলের এক চমৎকার জীবনযাত্রা প্রতিনিয়ত দোলছে এখানে। পোলাও উবিন আবার দেখা হবে অন্যসময়।
পিবিএ/এমএ/জেডআই