সুনামগঞ্জে বিশ মেট্রিকটন চাল আটকে ফের ‘জজ মিয়া নাটক !

পিবিএ,সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য গুদাম থেকে বেড়িয়ে যাবার পথে কালোবাজারি চক্রের সাড়ে ৬ লাখ টাকার সমপরিমাণ মুল্যের ২০ মেট্রিকটন ট্রাক বোঝাই চাল সহ একজনকে আটক করা হয়।

সোমবার বিকেলে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কতৃক চাল বোঝাই ট্রাক আটকের ঘটনায় জেলা শহরে তোলপাড় শুরু হয়েছে।,
মঙ্গলবার এমন ঘটনা জানাজানি হলে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, কালোবাজারি এমনকি খাদ্যগুদামে থাকা সংশ্লিষ্টদের হাড়ির খবর ও অপকর্ম ঢেকে রাখতে নিজেদের রক্ষায় শুধুমাত্র ট্রাক ড্রাইভারকেই মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে সুনামগঞ্জে নতুনকরে আরেক ‘‘জজ মিয়া’’ নাটকের সুত্রপাত শুরু হয়েছে বলে জেলাব্যাপী বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজনের মধ্যে নানা কানাগুসা চলছে।, ওই ঘটনায় সোমবার গভীররাতে সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বাদী হয়ে সুনামগঞ্জ মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন।

মামলায় প্রতারণা বা বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ এনে আসামী করা হয় লক্ষীপুর জেলার রামগড় উপজেলার হরিচ্চর দরগাবাড়ি গ্রামের আবুল কালামের ছেলে হতদরিদ্র ট্রাক ড্রাইভার শাহাদতকে।, সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা নং-২০, তারিখ ১৭.০৬.১৯, ধারা ৪০৬/৪২০/১৯০।

মামলায়‘ সুনামগঞ্জের স্থানীয় এক অটো রাইস মিলের নামে লেখা সংবলিত ’জব্দকৃত চালের বস্তায় চালের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২০ মেট্রিক টন (৬০০ বস্তা প্রতিটিতে ৩০ কেজি করে)।, যার বর্তমান বাজার মুল্য প্রায় ৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।, জব্দকৃত ট্রাক(যাহার নং-ঢাকা মেট্রো-ট-১৮-৮৩৯১)। ট্রাকের মুল্য নির্ধারণ করা হয়নি জব্দ তালিকায়।

মামলার এজাহার ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সুত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসক কার্যালযের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাহুল চন্দ সোমবার বিকেলে জেলা খাদ্য গুদামের ভেতর থেকে চাল বোঝাই ট্রাক বের হওয়ার পর ওই ট্রাকটি পার্শ্ববর্তী রাসেল অটো রাইস মিলে প্রবেশ মুখে থামিয়ে ড্রাইভারের নিকট চালের চালানপত্র দেখতে চান। ড্রাইভার কোন প্রকার চালান পত্র দেখাতে ব্যর্থ হলে তাকে নিয়ে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে প্রথমে কাউকেই খুজে না পেলেও কিছুক্ষণ পর এ কক্ষে উপস্থিত সুনীল চন্দ্র সরকারকে ড্রাইভার সনাক্ত করেন এবং বলেন এই সুনীল চন্দ্র সরকার মল্ল্কিপুর খাদ্য গুদাম এবং গুদাম পার্শ্ববর্তী রাসেল অটো রাইছ মিলে চাল পরিবহনের জন্য ট্রাকটি ভাড়া করেছেন।

এরপর খাদ্যগুদামে লোকজন জড়ো হলে জনসম্মুখে জিজ্ঞাসাবাদে ড্রাইভার জানায় ১৬ জুন রোববার বেলা তিনটায় ট্রাকটি নিয়ে সুনামগঞ্জের মল্লিকপুর সরকারি খাদ্যগুদামে প্রবেশ সে করেছে এবং এ ট্রাকে করেই আশুগঞ্জের স্থানীয় একটি মিল থেকে চালগুলো নিয়ে আসা হয়। ড্রাইভার আরো জানায়, ট্রাকে থাকা চাল অর্ধেক খাদ্যগুদামে আনলোড করার কথা ছিল এবং বাকি অর্ধেক চাল পার্শ্ববর্তী রাসেল অটো রাইস মিলে আনলোড হওয়ার কথা।

পরে জেলা প্রশাসন থেকে চালবোঝাই ট্রাক জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের হেফাজতে ও ড্রাইভারকে পুলিশ হেফাজতে হস্তান্তর করে একটি লিখিত নির্দেশনায় আটক ড্রাইভার, ট্রাক ভাড়া নেয়া সেই সুনীল সরকার, অটো রাইস মিল মালিক ও এবং অনৈতিক সুবিধাভোগী কালোবাজারিদের চাল বোঝাই ট্রাক গুদামে প্রবেশ- বাহিরে গুদামে থাকা সহায়তাকারিদের ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়।,
কিন্তু জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কালোবাজরিচক্র ও নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে ঘটনার দিন বিকেলে থেকে মধ্যরাত অবধি নানা নাঠকিয়তার পর আইনের ফাঁক তৈরী করে সেই গভীর রাতে শুধুমাত্র ড্রাইভারকে আসামী করে থানায় একটি ফরমায়েশি মামলা দায়ের করান।.

অতচ জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণে চিহ্নিত হওয়া সেই রাসেল অটো রাইস মিল মালিক, ট্রাক ভাড়াকারী সুনীল সরকার, খাদ্যগুদামে থাকা নিজ দফতরের সুবিধাভোগীদের নাম মামলার এজাহারে রাখা হয়নি। জানা গেছে, জব্দকৃত চালে ও সেই অটো রাইস মিলের মালিক সুনামগঞ্জ শহরের হাজিপাড়ার ব্যবসায়ী রাসেল আহমদ। তার বাবা সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম। সোমবার রাতে জব্দকৃত চাল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অটো রাইস মিল মালিক রাসেল গণমাধ্যমকে বলেন, রাইস মিলের এই চাল পরিষ্কার করার জন্য আশুগঞ্জে একটি মিলে পাঠানো হয়েছিল। আশুগঞ্জ থেকে পরিষ্কার করে ফিরিয়ে আনার পর খাদ্য গুদাম চত্বরে ট্রাক রাখা হয়েছিল কিন্তু চাল আশুগঞ্জ থেকে কেনা হয়নি।

ট্রাক ভাড়াকারী সুনীল সরকার কে? চাল পরিস্কার, চাল সুনামগঞ্জ থেকে আশুগঞ্জ আনা নেয়ায় ট্রাক ভাড়া সহ প্রতিকেজি চালের মুল্য কী পরিমাণ হতে পারে? এমন প্রশ্নের উওর এড়িয়ে যান ওই মিল মালিক।
মঙ্গলবার সুনামগঞ্জ সদর থানার ওসি মো. শহীদুল্লাহ বলেন, অতীতে কালোবাজারি চক্রের চাল আটকের পর যেসব ধারায় মামলা হয়েছে এ মামলায় সেসব গুরুত্বপুর্ণ ধারার উপস্থিতি নেই এরপর মামলার এজাহার যেভাবে দেয়া হয়েছে সেটি সম্পর্কে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক দফতর ভাল বলতে পারবেন।, এদিকে ঘটনার পর থেকে মঙ্গলবার দুপুর পর্য্যন্ত জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জাকারিয়া মোস্তফা গণমাধ্যমকে চাল আটকের ব্যাপারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম ভ’য়া বিভ্রান্তিমুলক তথ্য দিয়ে ঘটনাকে ভিন্নখাতে নেয়ার অপচেষ্টা করেন। সোমবার রাতে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, এ ঘটনায় তিন সদস্য বিশিস্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি, তদন্তকমিটি রিপোর্ট পেলে বলা যাবে আসল ঘটনা কী?

ফের মঙ্গলবার দুপুরে উনার সাথে এ প্রতিবেদক মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি নানাভাবে তথ্য দিতে গরিমসি করে সময়ক্ষেপণ করার পর বলেন, এ চাল গুদামে প্রবেশ বা বাহিরে যাবার ব্যাপারে অবশ্যই গুদামের ভেতরই খাদ্য নিয়ন্ত্রক দফতরের কেউ না কেউ তো জড়িত আছেই। সুনীল ও অটো রাইস মিল মালিককে কি মামলায় আসামী করা হয়েছে এমন প্রশ্নের উওরে বলেন , আসলে মামলায় ৩ থেকে ৪ জন অজ্ঞাতনামা আসামী রেখেছি।, চাল আটকের পর যে যে ধারায় মামলা হওয়ার কথা সেসব ধারার উপস্থিতি মামলায় না থাকায় চাল কালোবাজারি চক্রের সদস্যরা বা এ চাল গুদামের ভেতর বাহিরে আনা নেয়ার নেপথ্যে থাকাদের আইনের ফাঁক গলিয়ে বের হবার পথ তৈরী করে দেয়া হয়েছে কীনা জানতে চাইলে তিনি ফের বলেন, ভাই আমার অফিসের লোকজন যেভাবে বলেছে আমি সেভাবেই মামলা করার জন্য সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুর রউফকে বলেছি।,তিনি এ প্রতিবেদককে পরামর্শ দেন ,আপনি আপাতত মামলা অনুযায়ী সংবাদ লেখেন পরে আপনার সাথে সরাসরি সাক্ষাতে কথা হবে।,

অভিযোগ রয়েছে শুধু রাসেল অটো রাইস মিলের মতো জেলায় -উপজেলায় আরো একাধিক মিল মালিককে সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য গুদাম সহ অন্যান্য উপজেলা খাদ্য গুদাম ব্যবহারে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বাড়তি আয়ের উৎস হিসাবে ধান,চাল গম কেনা -বেচ,প্রবেশ বাহিরে যাবার ব্যবস্থা করে দেয়ার প্রথা গত দেড়যুগ ধরে চলে আসছে।, এদিকে সুনামগঞ্জের কৃষকরা ধান বিক্রি করতে না পারলেও কালোবাজারি চক্রের চাল আটকের মামলার নামে নতুন করে আরেক ‘জজ মিয়া’’ নাটক সুত্রপাত করার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জেলা কৃষক সমাজ ও সচেতন মহল।

মঙ্গলবার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, আমাদের স্থানীয় কৃষকরা ধান বিক্রি করতে পারছেন না। অথচ খাদ্যগুদামে দেয়ার জন্য চাল বাইরে থেকে আনা হয়ে থাকলে সেটি দুঃখজনক হবে। এ বিষয়টি উপর নজরধারী করছে জেলা প্রশাসন ও খাদ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল উর্ধ্বতন কতৃপক্ষ।,

পিবিএ/এইচএস/হক

আরও পড়ুন...